ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের ৯ বছরের যাত্রায় আমরা বিভিন্ন ভলান্টিয়ারের সাহসিকতা, মহানুভবতার দৃষ্টান্ত দেখেছি। কিছুদিন আগে আমাদের একজন ভলান্টিয়ারের কাছ থেকে পাওয়া এই ঘটনাটি অনেককেই অনুপ্রাণিত করবে আশা করছি।
“মানবতা” শব্দটা অনেক ছোট তাই না! আমার কাছে এটি বিশাল বড় শব্দ। কারন, আমি একজন স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছাসেবকদের প্রধান কাজই হলো মানবতা দেখানো। গত ১৩ই জুন বিকাল ৫টায় আমি মৌসুমি ফল লিচু কেনার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সুপার মার্কেটে যাই। কিছুক্ষণ আগে ঝুম বৃষ্টির রেশ তখনও কাটেনি। টপটপ বৃষ্টিতে আর করোনার ছোবলে শহরে একদম স্তব্ধ নিরবতা। হঠাত দেখলাম এক সুঠাম দেহের যুবক ডাষ্টবিন থেকে পঁচা/ দূর্গন্ধযুক্ত আম কুড়িয়ে খাচ্ছে ক্ষিধের জ্বালায়। হতবাক করে দেয় দৃশ্যটা। নিজের অজান্তেই চোখের কোণে পানি চলে আসল। শহরের নীরবতায় সব রেষ্টুরেন্টও বন্ধ ছিল। তাই একটু দূরে দেখলাম এক লোক আম বিক্রি করছে। দৌড়ে গিয়ে ১ কেজি আম এনে তাকে দিলাম। দৃশ্যটা মুঠোফোনে ধারন করলাম। বিশ্বাস করবেন কি না জানিনা, উনার ক্ষিধের জ্বালায় আম খাওয়ার দৃশ্যটা আর মোবাইলে ভিডিও করতে সাহস হয়নি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছি আর কেঁদেছি। ভিডিওটি রাতে পোষ্ট করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম ফেসবুকের অন্যান্য বন্ধুরা ভিডিওটি অন্য গ্রুপে পোষ্ট করায় সবার কষ্টে ভরা কমেন্টস পরছিল সকল পোস্টে। মুহূর্তের মধ্যেই ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায়। এইসব কমেন্টস দেখে কেন তাকে এক মুঠো ভাত খাওয়ালাম না, সেজন্য নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল। যদিও ঐ সময় আশেপাশে কোন রেষ্টুরেন্ট খুঁজে পাইনি।
মানবতা আমাকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আঘাত করে জর্জরিত করছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম উনাকে খুঁজে বের করব। প্রতিদিন সময় করে রিক্সা দিয়ে ৪-৫ ঘন্টা পুরা শহর খুঁজতাম। বিভিন্ন মানুষকে উনার ভিডিও দেখাতাম। উনাকে দেখেছে কি না জিজ্ঞেস করতাম। খোঁজ না পেয়ে খুবই আশাহত হতাম।বৃহস্পতিবার দিন গিয়ে রাতে কেন জানি ভাল লাগছিলনা। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০টা। শহর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঐ ব্যক্তিটিকে ১ ঘন্টা খুঁজবো। ১ ঘন্টা খোঁজার পর রাতের অন্ধকারে এক ডাষ্টবিনের পাশ থেকে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে দেখলাম একজনকে। ডাক দিলাম দেখলাম সারা শরীর ভিজে চুপসে গেছে ডাষ্টবিনের ময়লায়। মায়াভরা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ক্ষিধে লেগেছে? খাবেন কিছু? ভাত খাওয়াতে চাচ্ছিলাম আপনাকে। মাথা নেড়ে সায় দিল। রিক্সায় উঠালাম। পাশে বসালাম। রাত তখন প্রায় ১১:৩০। সব রেষ্টুরেন্ট বন্ধ। শহরের অন্য প্রান্তের বড় একটি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে আসলাম। উনার পছন্দমত মাংস+ভাত+চা পেট ভরে খাওয়ালাম। একে একে চার প্লেট ভাত যখন খাচ্ছিল, তখন নিজের মনে খুব প্রশান্তি অনুভব করছিলাম। তারপর ১ ঘন্টা জিজ্ঞেস করলাম পরিচয় জানার জন্য। বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলাম। একবার শুধু নাটোর শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারন করেছিল।
উনার পর্ব শেষ হওয়ার পর রাতে যখন বাসায় ফিরেছি ঠিক তখন বাজে রাত ১ টা। সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুমাবো না। ল্যাপটপ নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। নাটোর জেলার কিছু অনলাইন পত্রিকা সার্চ দিলাম। ৮-১০টি পত্রিকার ই-মেইল ও মোবাইল নম্বর নিয়ে উনার পরিবারের নিকট পৌঁছে যাওয়ার জন্য উনার ছবি ও ভিডিও সম্বলিত একটি ফাইল ঐ পত্রিকার সম্পাদকের কাছে পাঠালাম। সকালে কয়েকজন সাংবাদিককে কলও দিলাম। ওরা আমাকে সাহায্য করবে এবং আমার ঘটনাটি নিউজ আকারে ঐ এলাকার স্থানীয় পত্রিকায় ও ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে পোষ্ট দিবে এই মর্মে কথা দিল। সন্ধ্যায় একটা কল আসলো মোবাইলে। নাটোর জেলা সিংড়া থানার একজন ইউনিয়ন এর উদ্যোক্তা। ওনার নাকি লোকটি পরিচিত। একটি গ্রুপে আমার নাম্বার নিয়ে কল করেছে আমায়। ওনার নাম সুহেল রানা ডোকা। বাড়ি নাটোর জেলার সিংড়া থানার শতকুড়ি গ্রামে। আলোচিত তরুণদের আইডল, জুনাইদ আহমেদের পলক এর এলাকা। লোকটি ১-২ বছর নয়, ৯ বছর ধরে নিখোঁজ। মা-বাবা, এক ছেলে এক মেয়ে, এক ভাই ও দুই বোন বাড়িতে আছে। সবাই অপেক্ষা করছে এখনও। মা সেই ৯ বছর ধরে কাঁদতে কাঁদতে পাগল প্রায়। বৃদ্ধা মা অপেক্ষা করছে, কিন্তু অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না। আমার সংগ্রহে থাকা আরও ভিডিও ও ছবি উনার মোবাইলে পাঠালাম। একটু পরেই উনার বাড়িতে মিটিং হলো। ভিডিও কলে সবাই আমার সাথে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছিল। তার এক মাত্র ভাই ও তার এক নিকট আত্মীয় সাথে সাথেই রওয়ানা দিল এখানের জন্য।
রবিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এসে পৌঁছালো। আবার তাদের নিয়ে ঐ ব্যক্তিটিকে সারাদিন খোঁজার পর সন্ধ্যায় পেলাম। ভাইকে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। কয় বছর পর দেখা জানেন? ৯ বছর পর। সাথে সাথে মোবাইল দিয়ে মাকে কল দিল। কি যে কান্না মায়ের। ওদের গ্রাম নাটোরের বাড়িতে সবার ঈদের আনন্দ। ভাইকে ছাড়তেই চায়না। রেষ্টুরেন্টে নিয়ে পেট পুরে খাওয়ালাম। প্রশান্তির আনন্দ। কত অনুনয় বিনয় করলাম। থাকার জন্য এক মুহূর্তও অপেক্ষা করবে না। ৯ বছর পর দেখা ভাইকে নিয়ে এখনই রওয়ানা দিতে চায়। বিদায় না দিয়ে কি উপায় আছে? মা যে অপেক্ষা করছে সন্তানকে বুকে নিবে। যাওয়ার আগে বলে গেছে তাদের গ্রামে আমি নাকি শান্তির দূত। হ্যাঁ, আমি শান্তির দূতই। এই মানবতা শিখিয়েছে জাগো ও ভিবিডি। ভিবিডি শিখিয়েছে কিভাবে অসহায়দেরও বুকে টেনে নিতে হয়, কিভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়। ২০১৪ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আমাকে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ভাল কাজের জন্য স্যালুট জানাচ্ছে। আর আমি স্যালুট জানাচ্ছি জাগোকে। আমাকে এমন একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান জাগো ফাউন্ডেশন এবং ভলান্টিয়ার ফর বাংলাদেশের।